ঢাকা,বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪

চকরিয়ার রশিদ আহমদ চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয় : কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে

নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার :: করিয়ার রশিদ আহমেদ চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে প্রায় কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এমন একটি অভিযোগের তদন্ত চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থেকে পৌঁছেছে চকরিয়া মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের কার্যালয়ে। এদিকে তদন্ত বাধাগ্রস্ত করতে বারবার সময় নিয়েও উপস্থিত না হওয়ায় প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্বয়ং চকরিয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। 

অভিযোগ উঠেছে, প্রধান শিক্ষক নিজ স্ত্রীকে লাইব্রেরিয়ান নিয়োগের নামে এমপিও করেছেন সহকারী শিক্ষক পদে। লাইব্রেরিয়ান থেকে সহকারী শিক্ষক হয়ে স্বামী স্ত্রী-দুজন যৌথভাবে গড়েছেন লুটের সাম্রাজ্য।

এ বিষয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, জেলা শিক্ষা অফিসার ও বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতির (চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষকগণ। অভিযোগটি বর্তমানে চকরিয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা তদন্ত করছেন বলে তিনি নিশ্চিত করেছেন।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও রশিদ আহমেদ চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি মো: ফখরুল ইসলামের কাছে দেওয়া লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, বিদ্যালয়ে ২০০৮ সালের শেষ দিকে  বর্তমান প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। তার দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মনসুর উদ্দিন, ছৈয়দুর রহমান, মশরুরা জান্নাত, মোহাম্মদ শহিদুল ইসলামকে এমপিও বাতিলের হুমকি দিয়ে আসছেন প্রধান শিক্ষক।
তিনি বিদ্যালয়ের জমি ক্রয়ের নামে দুইবার ভাউচার করে পাঁচ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। বিদ্যালয়ের পুরাতন মসজিদ ভাঙ্গারী বিক্রি করে ১লক্ষ ১০ হাজার টাকা স্কুল ফান্ডে জমা না করে আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়া বহিরাগত শিক্ষার্থীদের গত ১০ বছরে এসএসসি পরীক্ষায় রেজিস্ট্রেশন করে  ফরম ফিলাপের মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। শহীদ মিনারের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ থেকে প্রাপ্ত বরাদ্দ ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা শহীদ মিনার নির্মাণ না করেই আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া স্কুলের সভাপতির স্বাক্ষর জাল করে অগ্রণী ব্যাংক খুটাখালী বাজার শাখা থেকে প্রায় ৪ লক্ষ টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন বলে জানানো হয়। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার ফি সমূহ রশিদ বিহীন আদায় করে প্রায় ১০ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলেও দাবি করা হয় লিখিত অভিযোগে।
এছাড়াও বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ অডিট রিপোর্টের তদন্ত কমিটির উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী ১১ লক্ষ ৯৭ হাজার টাকা আত্মসাৎ এর প্রমাণ পাওয়ার পরও ওই টাকা বিদ্যালয়ের একাউন্টে জমা করেননি প্রধান শিক্ষক। বিদ্যালয়ের ল্যাপটপ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সামগ্রী নিজ বাসায় নিয়ে ৭ লক্ষ টাকার মতো সামগ্রী ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগে দাবি করা হয়েছে। এছাড়াও অবৈধ কাগজপত্র সৃজন করে প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন তার স্ত্রী পারভিন আক্তারকে সহকারি লাইব্রেরিয়ান থেকে সরকারি শিক্ষক (সমাজবিজ্ঞান) পদে নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়াই চাকরি দিয়েছেন। বিধি মোতাবেক পত্রিকায় লাইব্রেরিয়ান এর বিজ্ঞাপন দিলেও ২০১১ সালের ৮এপ্রিল নিয়ম অনুযায়ী তাকে লাইব্রেরিয়ান নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে এমপিওভুক্ত করার সময় কাগজপত্র সৃজন করে সহকারী শিক্ষকের পদ বানিয়ে এমপিও করান প্রধান শিক্ষক তার স্ত্রীকে। সহকারী শিক্ষকের সমাজবিজ্ঞান পদের জন্য কোন ধরনের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ও দেওয়া হয়নি। এমনকি কোন নিয়োগ পরীক্ষাও গ্রহণ করা হয়নি বলে দাবি করেন বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক।
গত বছর জানুয়ারি থেকে জুলাই মাসের অর্থাৎ সাত মাসের বিদ্যালয়ের আর্থিক বিষয় নিয়ে অভ্যন্তরীণ একটি অডিট কমিটি গঠিত হয়। ৫ সদস্য বিশিষ্ট অডিট কমিটিতে ছিলেন সহকারি প্রধান শিক্ষক শাহাদাত হোসেন,পরিচালনা কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধি সুরত আলম, সিনিয়র শিক্ষক শহিদুল ইসলাম, পরিচালনা কমিটির অভিভাবক প্রতিনিধি মাওলানা গিয়াস উদ্দিন, দিদারুল আজম। তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে ১১ লক্ষ ৯৭ হাজার টাকার নানা অনিয়ম ধরা পড়ে। ওই টাকা স্কুল ফান্ডে জমা করার জন্য প্রধান শিক্ষককে অডিট রিপোর্টে উল্লেখ করা হলেও কোন টাকা জমা না দিয়ে তিনি ওই ম্যানেজিং কমিটি ভেঙ্গে দেন।
এমন পরিস্থিতিতে প্রায় কোটি টাকা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনে গত ৪ অক্টোবর চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম বরাবরে লিখিত  অভিযোগ দায়ের করেন সিনিয়র শিক্ষক মোঃ শহিদুল ইসলাম। অভিযোগটি চকরিয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার নজরুল ইসলামকে তদন্ত পূর্বক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
এ ব্যাপারে চকরিয়া মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, অভিযোগটি পাওয়ার পরে আমার একাডেমিক সুপারভাইজার রতন বিশ্বাসকে তদন্তভার দেওয়া হয়। তবে প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন বারবার সময় চেয়ে আবেদন করে তদন্তে উপস্থিত না হওয়ায় তদন্ত কার্যক্রম স্বাভাবিক করা যাচ্ছে না। অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক বেশ কয়েকবার আবেদন করে সময় নিয়েছেন। যার কারণে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো তদন্তের অগ্রগতি করতে আমরা পারছি না। কেন বারবার সময় নিচ্ছেন সেই বিষয়টি নিশ্চয়ই আপনারা বুঝতে পারছেন এমন মন্তব্য করেন মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা।
অভিযোগ তদন্তের বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা চকরিয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের একাডেমিক সুপারভাইজার রতন বিশ্বাস বলেন, নিয়ম অনুযায়ী অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষককে তদন্তে উপস্থিত হওয়ার জন্য নোটিশ প্রদান করেছি। তবে তিনি পনেরো কর্মদিবস সময় চেয়েছেন। ওই কর্ম দিবস অতিবাহিত হওয়ার পর তাকে পুনরায় নোটিশ দেওয়া হবে। উপস্থিত না হলে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিদ্যালয়ের টাকা আত্মসাৎ ও নানা অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন বলেন, আমার বিরুদ্ধে এটি ষড়যন্ত্র। আমি কোন টাকা আত্মসাৎ করিনি। এখন আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত চলছে। তদন্তে নির্দোষ প্রমানিত হব আশা করি। চীন চলে যাওয়া শিক্ষকের বেতন উত্তোলন করে আত্মসাৎ এবং স্ত্রীকে লাইব্রেরিয়ান থেকে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে কোন উত্তর না দিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন।

পাঠকের মতামত: